ঘাঘড়া শাক থেকে সাবধান ! গোপন আততায়ী ঘাতক !! - বঙ্গ সমাচার ঘাঘড়া শাক থেকে সাবধান ! গোপন আততায়ী ঘাতক !! - বঙ্গ সমাচার

মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

জরুরী বিজ্ঞপ্তি :
জেলা ভিত্তিক প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আমাদের পরিবারে যুক্ত হতে আপনার সিভি পাঠিয়ে দিন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়। বিজ্ঞাপনের জন্য  ইমেইল করুন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়।

ঘাঘড়া শাক থেকে সাবধান ! গোপন আততায়ী ঘাতক !!

ঘাঘড়া, একটা শাকের নাম। গ্রামে-গঞ্জে পরিত্যক্ত, আবাদি ও অনাবাদী জমিতে এই শাকটি বিনা চাষেই শুষ্ক মৌসুমে জন্মে। এর কাঁটাযুক্ত গোটা নিয়ে ছোট বেলায় একে অপরের চুলে লাগিয়ে মজা করেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে।এই শাক অনেকেই মজাকরে রান্না করে খায়। কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে এই শাক মাঝে মধ্যেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠে। এই ঘাঘড়া শাকে এক ধরনের টক্সিন তৈরী হয় যা মানবদেহ এমন কি পশুদের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে কচি অবস্থায় এবং অতি বয়স্ক অবস্থায় খেলে মানবদেহের যতেষ্ঠ ক্ষতি করে, এমন কি মৃত্য পর্যন্ত হতে পারে।

“শাক কইয়া বড় ঘাঘড়া শাক খাইতাম। বউ বাচ্চা মরি যাওয়ার পর থাকি আর ঐ শাক মুকউ দেই না”। কথাগুলো গোয়াইনঘাট উপজেলার লাঠি গ্রামের হাবিবুর রহমানের। ২০০৭ সালের নভেম্বরে মাসে কচি ঘাঘরা শাক খেয়ে অসুস্থ হয়ে তার স্ত্রী ও ২ কন্যা সন্তান মারা যায়। শুধু হাবিবুর রহমানের পরিবার নয়, তখন লাঠি গ্রামের আমিন উদ্দিন, আব্দুস সালাম, আনোয়ার মিয়া ও আমির উদ্দিনের পরিবারেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

এছাড়াও উপজেলার দেওয়ান গ্রাম, কনফুরি গ্রাম ও গোরা গ্রাম এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শিমুল তলা আদর্শ গ্রাম, কাঠাল বাড়ি, টুকেরবাজার, বটের তল, ঢালারপাড়, উত্তর ঢালার পাড় ও মেঘারগাঁও গ্রামেও এই শাক খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তখন দুই উপজেলায় ১৩ জন করে মোট ২৬ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে শিশু ও মহিলার সংখ্যাও বেশি। শাক খেয়ে মারা যাওয়া পরিবারের লোকজন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই শাক খেয়ে আসছি। তবে বড় শাকটা খেতাম। কিন্তু যখনই আমরা ছোট ও কচি ঘাঘরা শাক খাই তখনই অসুস্থ হয়ে মহিলা ও শিশু মারা যায়। এখন আমরা যেমনি ঘাঘরা শাক খাওয়া থেকে দূরে থাকি, তেমনি এলাকার মানুষ ও এ শাক খাওয়া থেকে বিরত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘাঘরা শাকের বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণকারীরা পেশায় দিনমজুর ও আর্থিকভাবে দুর্বল। দিনমজুর ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না থাকার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এলাকার মানুষজন এই শাক খায়। আর খাওয়ার পরই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৭ সালের নভেম্বরে মাসের প্রথম দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাটের লাঠি গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী মোস্তফা বেগম (৩০), কন্যা হেলেনা বেগম (১২), হেনা (৭), আমিন উদ্দিনের তিন কন্যা সুমি (৮),রুমি (৬), সুহিনা (৩), আব্দুস সালামের ১৮ বছরের যুবক কবির হোসেন, আনোয়ার মিয়ার ৩ বছরের কন্যা রিয়া, আমির উদ্দিনের দেড় বছরের শিশু কন্যা আলকুমা বেগম এই ঘাঘরা শাক খেয়ে মারা যায়।

এছাড়াও একই উপজেলার দেওয়ার গ্রামের ইউনুছ মিয়ার পুত্র আলকাছ মিয়া (১০), কনফুরি গ্রামের আব্দুল জলিলের পুত্র আব্দুল খালিক (১১), গোরাগ্রামের মুজেফর আলীর পুত্র রেজাউল করিম (৮) ও কন্যা নাজমা (৪)। আর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলা আদর্শ গ্রামের রাশেদা বেগমের মেয়ে তানিয়া (১০), লাকি (৭), মঈন উদ্দিনের মেয়ে মোমিনা (৮)। কাঠালবাড়ি গ্রামের মোঃ আব্দুল্লার ২ মেয়ে আছিয়া (৮) ও রীনা (৭)। টুকেরবাজার গ্রামের আব্দুল কাদেরের পুত্র সুহেল (৪)। বটেরতল গ্রামের সিকন্দর আলীর স্ত্রী হনুফা (৪৫)। ঢালার পাড় গ্রামের আব্দুল খালিকের কন্যা রোজিনা (১২) ও সুলায়মানের কন্যা রুমানা (৪)। উত্তর ঢালারপাড় গ্রামের আব্দুল বারিকের পুত্র রুবেল (১২) ও হাবু মিয়ার কন্যা আসমা (৮)। মেঘারগাঁও গ্রামের সাজু মিয়ার পুত্র সাইফুর রহমান (৮) ও স্বরূপা (৪)।

তখন দুই উপজেলায় শুধু এই শাক খেয়েই শতাধিক লোক আক্রান্ত হয়। পরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে ঐ সকল মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, ছোট ঘাঘরা শাক খাবার কারণে তাদের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ঢাকা ও সিলেটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও গত ১৯ থেকে ২৬ জানুয়ারি আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে সিলেট জেলা সিভিল সার্জনের সহযোগিতায় মহানগরী, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজারসহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় জনসংযোগ, প্রচারপত্র বিতরণ, পোস্টার লাগানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠান দুটির গবেষণায় ধরা পড়েছে কচি ঘাঘরা শাক খুবই বিষাক্ত। তা খাওয়ার পর মানুষের মস্তিষ্ক, লিভার বিষে আক্রান্ত হয়্ তাতে মৃত্যুও ঘটে। শাকটির কচিপাতা ও বীজের মধ্যে থাকা ‘কার্বোজাট্টাক্টাইলোসাইড’ নামে এক প্রকার বিষাক্ত উপাদানের কারণে তা ঘটে।

ঘাঘরা শাক স্থানীয়ভাবে ‘ঘাঘরা, ‘আগরা’ ও ‘হাগরা’ নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘জেনথিয়াম স্টোমারিয়াম’। যখন দুই থেকে চারটি পাতা গজায় তখন সেটি খুবই বিষাক্ত থাকে। হাওর অঞ্চলের অনেক গরীব মানুষ এর ওপর নির্ভর করে বলে আইইডিসিআর’র সম্পতি প্রকাশিত পুস্তিুকায় উল্লেখ করা হয়। বছরে সারাদেশে কত মানুষ তা খেয়ে অসুস্থ হয় বা মারা যায় এসব তথ্য গবেষণা প্রতিবেদনে নেই। তবে তাতে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষকে কিভাবে মৃত্যু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, ঘাঘরা শাক খেয়ে অসুস্থতা এবং মৃত্যু তার একটি উদাহরণ। গবেষণা মতে, শুধু মানুষ নয়, অন্য প্রাণীরাও তা খেলে তা খেলে অসুস্থ হয় বা মারা যায়।

জিম্বাবুয়েতে ১৯৯৭ সালে শাক পাতাটি খেয়ে অনেক শুকর অসুস্থ হয়ে পড়ে। শাকটি খাওয়ার পর রোগের লক্ষণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, বমি করা, অস্থিরতা, অচেতনতা ও সকৃত এনজাইম বেড়ে যাওয়ার কথা। আইইডিসিরি এর উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন, আইসিডিডিআরবি’র মোঃ সাইফুল ইসলাম, দাস্তগীর হারুন, মাহবুব উল আলম প্রচারনায় অংশ নিয়েছিলেন। গবেষক দল আশা প্রকাশ করেন যে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছোট ঘাঘরা শাকের বিষক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হবেন এবং জনগণকে ছোট ঘাঘরা শাক খাওয়া থেকে বিরত রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন। সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. এম ফয়েজ আহমদ জানান, কচি ঘাঘরা শাকে বিষাক্ত উপাদান বিদ্যমান। যা রান্নার পরেও অটুট থাকে। তাই ঘাঘরা শাক বিক্রি না করা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ঘাঘরা শাকের বিষের কথা প্রতিবেশিদের জানানোর আহ্বান জানান তিনি।

সংবাদটি শেয়ার করুন


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পূর্বানুমতি ব্যাতিত এই সাইটের কোন লেখা, ছবি বা ভিডিও ব্যাবহার করা নিষিদ্ধ।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com