স্বাধীন দেশের পরাধীন গ্রাম - বঙ্গ সমাচার স্বাধীন দেশের পরাধীন গ্রাম - বঙ্গ সমাচার

বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:০৩ অপরাহ্ন

জরুরী বিজ্ঞপ্তি :
জেলা ভিত্তিক প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আমাদের পরিবারে যুক্ত হতে আপনার সিভি পাঠিয়ে দিন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়। বিজ্ঞাপনের জন্য  ইমেইল করুন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়।

স্বাধীন দেশের পরাধীন গ্রাম

নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার সন্ধ্যার পর মারা গেলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের এক গ্রামে তার বাড়ি। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাই বলা চলে বয়সজনিত কারণেই মারা গেছেন তিনি। জানাজা তার বাড়ির পাশেই একটি মাদ্রাসায় জোহরের নামাজের পর অনুষ্ঠিত হবে। শহর থেকে বেশি দূরে নয় অথবা আমারও তো বয়স হয়েছে, এ সব ভেবেই চলে গেলাম ওই মুক্তিযোদ্ধার জানাজায়। বেশ লোক সমাগম হয়েছে। দাঁড়ালাম জানাজায়। যথারীতি মৃত মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে ইউএনওর নেতৃত্বে হাজির হলো পুলিশের একটি চৌকস দল। বেজে উঠল বিউগল। পাশের মুসল্লি কানে আঙুল দিলেন। ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কানে আঙুল দিচ্ছেন কেন? সেও ফিস ফিস করে জবাব দিল, মৃতদেহের সামনে বাঁশি বাজানো না-জায়েজ, শেরেকি গুনাহ্। চমকে উঠলাম আমি।

পরের দিন ওই মুক্তিযোদ্ধার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে শহরে দেখা। বললাম, তোমার ভাইয়ের জানাজায় তো মানুষজন ভালোই হয়েছিল। তার উত্তর— হ্যাঁ, হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিল, বাইরের গ্রাম থেকেও এসেছিল অনেকে। তবে গ্রামের মানুষ কম। তারা অন্য বাহামের লোক। এ কথা শুনে বিউগল বাজার সময় পাশের লোকের কানে আঙুল দেওয়ার কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের গ্রামে মৌলবাদীদের প্রভাব কি বেশি? সে সংকুচিত হয়ে হাত ধরে নিয়ে গেল চায়ের দোকানে। চা খেতে খেতে সে যা জানাল তা রক্ত হিম হওয়ার মতো। সে বলল, সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের সব জায়গায় মুসলিম লীগ হারলেও এ গ্রামে ওরাই জিতেছিল। যুদ্ধ শুরু হলেই আমার এ ভাইটি চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। তখন গ্রামের ওই অংশটি আমার বাবাকে অনেক হেনস্থা করেছে। যুদ্ধ শেষে ওরা চুপচাপ ছিল কিছুদিন। তারপর আবার শুরু হয় ওদের তৎপরতা, যা এখনও চলছে।

একই ধরনের অবস্থার খোঁজ পাওয়া গেল পাশের বহুলী ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামেও। সিরাজগঞ্জ শহরের পাশ্ববর্তী বহুলী ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সংঘটিত হয় গণহত্যা। সেখানে এখনও কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। স্থানটিকে আলাদা করেও রাখার ব্যবস্থা হয়নি। ওই গ্রামের এক কলেজ ছাত্রীকে জানানো হলো যে, গণহত্যার স্থানটিতে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আগামী ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শহীদদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানো যাবে কি-না? ছাত্রী জানাল, সে জানে না কোথায় গণহত্যা হয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানাবে সে। কয়েক দিন পরেই ফোন করে সে জানাল, হ্যাঁ গণহত্যার জায়গাটি চিহ্নিত করা গেছে। গ্রামের অনেকেই জানে ঘটনাটি। কিন্তু ২৫ মার্চে শহীদদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কেন? প্রশ্ন করতেই সে জানাল, গ্রামের অনেকেই বলেছে, মৃতদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানো ‘হিন্দুয়ানি কালচার’, তাই গ্রামের মানুষ শহীদদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালাবে অথবা জ্বালাতে দেবে বলে মনে হয় না।

ওই গণহত্যায় শহীদ এক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। কিন্তু তারা কেউ শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন বা শহীদদের ব্যপারে কোনও কথা বলতে নারাজ। কী হবে আর এসব কথা মনে করে? অনেক চাপাচাপিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালো, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের একজন মারা গেছে, এতে গর্ব করা উচিত। কিন্তু সেই গর্ব করার সাহস আমাদের নেই। মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল শহরে মিছিল করে সাহস দেখাতে পারে, কিন্তু গ্রামে আসতে তাদের দেখা যায় না। এলেও সড়ক দিয়ে এসে সড়ক দিয়েই চলে যায়। আর গ্রাম? পাকিস্তান আমলেও যারা গ্রাম শাসন করেছে, এখনও তারাই করে। আপনারা দেশ স্বাধীন করেছেন, কিন্তু এখনও কি গ্রামকে পুরনো মাতবরের কবল থেকে বের করে আনতে পেরেছেন? স্বাধীন দেশের গ্রামগুলো এখনও পরাধীনই রয়ে গেছে, তাই এখানে স্বাধীনতার কথা অর্থহীন।

কথাগুলো যতই কানে সিসা ঢেলে দিক, এসব কথার উত্তর দেওয়া সত্যিই মুশকিল।

সংবাদটি শেয়ার করুন


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পূর্বানুমতি ব্যাতিত এই সাইটের কোন লেখা, ছবি বা ভিডিও ব্যাবহার করা নিষিদ্ধ।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com