‘ঈশ্বরপুত্রদের’ মানুষ হবার লড়াই - বঙ্গ সমাচার ‘ঈশ্বরপুত্রদের’ মানুষ হবার লড়াই - বঙ্গ সমাচার

শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন

জরুরী বিজ্ঞপ্তি :
জেলা ভিত্তিক প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আমাদের পরিবারে যুক্ত হতে আপনার সিভি পাঠিয়ে দিন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়। বিজ্ঞাপনের জন্য  ইমেইল করুন bongosamacharnews@gmail.com এই ঠিকানায়।

‘ঈশ্বরপুত্রদের’ মানুষ হবার লড়াই

সব আছে স্কুলটিতে, তবু শিক্ষার্থী মাত্র ৪৪ জন! যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রের একটি সরকারি স্কুলের এমন হাল মেনে নেয়া যায় কি? তবু ওদের নিয়েই চলছে। বুক চিতিয়ে বিদ্যালয়ে পড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। মানুষ করতে হবে ওদের।

ওই শিক্ষার্থীদের ৩৭ জন আবার আলাদাভাবে চিহ্নিত। ইতিহাসে সোনার অক্ষরে নয়, কান্নার নীল হরফে লেখা রয়েছে যাদের নাম। তারা আর কেউ নয়- দলিত সম্প্রদায়। তাদেরই কচি কাঁচা শিশুরা স্বপ্ন দেখছে লেখা পড়া শিখে অনেক বড় হবে।

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আনন্দ বিশ্বাসের স্বপ্ন বড় হয়ে পুলিশ হবে। ডাক্তার হতে চায় অপর্ণা, হাসিখুশির ইচ্ছে নাচের শিল্পী হওয়া, রাহুল হবে ক্রিকেটার, সুবর্ণা হবে শিক্ষক। এরা সবাই কিন্তু পেশায় পরিচ্ছন্নকর্মীর সন্তান। যাদেরকে দলিত বা হরিজন সম্প্রদায় বলা হচ্ছে।

ধর্ম-বর্ণ বিভাজনে প্রায় ‘একঘরে’ হয়ে থাকা জমজ দুই ভাই করণ-অর্জুন, অভিজিৎ, শুভ, শিপন, সঞ্জনা, প্রীতি, মিনহাজসহ এসব শিশু সমাজের মূল ধারায় ফিরে আসতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মায়েরাও স্বপ্ন দেখছেন তাদের সন্তানরা বড় কিছু হোক।

‘আমাদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে জীবন বদলানোর সুযোগ খুব কম পায়। কারণ, আমাদেরকে তো মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। তারপরেও নানা বাধা বিঘ্ন পার করে তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছি।’ ৭ বছর বয়সী মেয়ে সোহানার দিকে তাকিয়ে এভাবেই বলছিলেন মা মালা রানী। যশোর পৌরসভায় কাজ করেন তিনি। তার দুই মেয়ে পড়ে মসজিদ মহল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা এ স্কুলে পড়ে বলে অন্য সম্প্রদায়ের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের এখানে ভর্তি করতে চান না। সে জন্য অন্য সব স্কুলের তুলনায় এখানে ছাত্র-ছাত্রী অনেক কম। ধর্মের পাশাপাশি সামাজিক এমন বৈষম্যের কারণে তাদের সন্তানরা যে ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না সে আক্ষেপ মালা রানীর। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ এমন শ্লোগানে যখন সরকার এগিয়ে যাচ্ছে তখন শুধুমাত্র ধর্ম-বর্ণ বিভাজনে পেশার কারণে এমন বৈষম্য থাকা উচিৎ বলে মনে করেন না তিনি।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক দীপংকর দাস রতন বলেন, ‘দেশে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে এমনটাই দাবি করেন শাসককুল এবং বোদ্ধাগণ। উঁচু ভবন, হাইওয়ে, ব্রিজ স্টেডিয়াম সবই হচ্ছে বেশুমার। প্রযুক্তির উন্নয়ন তো মাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু মনোজাগতিক দিক দিয়ে কতটুকু এগোলাম হিসেব করে দেখেছে কি কেউ? কথিত বর্ণ বিভাজনে দলিত-হরিজন, অন্ত্যজ, যৌনকর্মী এবং আর্থিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এখনো বঞ্চনা, লাঞ্ছনার সহজ লক্ষ্যবস্তু।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মসজিদ মহল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এদের সন্তানেরা পড়ে অতএব ‘ভদ্রলোকের’ ছেলেমেয়েদের আসতে নেই। না আসুক, আমরা এদের নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফল নয়। মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং ক্রীড়া সবদিকেই খেয়াল রাখছি। সবাইকে না পারি; কয়েকজন অন্তত তৈরি হোক এমনভাবে যে মূল স্রোতধারার হর্তা-কর্তারা চমকে যাক। সম্ভ্রমে স্যালুট করতে বাধ্য হোক।

যশোর রেলগেট এলাকার হরিজন পল্লিতে বেড়ে ওঠা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ২০০৯ সালে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেন হিরণ লাল সরকার। তিনি জানান, সরকারের নানামুখী কর্মপরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গ্রামে-গঞ্জে, হাওরে-পাহাড়ে বেড়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও আজ বিদ্যালয়মুখী। আমরাও চাই এর সুফল পেতে।

শিক্ষা সাগরের এই ঢেউয়ে সমাজের মূল ধারার অংশ হয়ে মানুষের মর্যাদা চাই আমরা। ‘তুমি- আমি সবাই মানুষ’ এই দর্শনে চাই স্বাভাবিক জীবনাচরণ।

তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তনের ঢেউয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে ধর্মে-ধর্মে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বৈষম্য না থাকলেও এখনও ধর্মীয় বেড়াজালে মানসিক বৈষম্য বিদ্যমান। যা আমাদের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ থেকে উত্তোরণ প্রয়োজন।

জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে ঐতিহাসিক বা পন্ডিতদের কাছে ‘দলিত’ নামে পরিচিতি পায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে দুই ধরনের দলিত জনগোষ্ঠীর দেখা মেলে। একটি বাঙালি দলিত শ্রেণী, অন্যটি অবাঙালি দলিত শ্রেণী।

অবাঙালি দলিত বলতে আমরা বুঝি ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-১৮৫০) বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক (১৮৫৩-৫৪), জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, উড়িষ্যা, কুচবিহার, রাচি, মাদ্রাজ ও আসাম থেকে হিন্দি, উড়িষ্যা, দেশওয়ালি ও তেলেগু ভাষাভাষী মানুষের পূর্ব পুরুষদের নিয়ে এসেছিল। দরিদ্র এই অভিবাসীরা দেশের সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং সিলেটে চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।

হরিজনরাও আমাদের দেশের, সংস্কৃতিরই একটি অংশ। হরিজনদের এভাবে ঘৃণা করে আমরা কি সত্যিই পারবো দেশের সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে?

দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠী, এমনকি আদিবাসীদের তুলনায়ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা পিছিয়ে রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ নিরক্ষরতা। একথারই পুনরাবৃত্তি করলেন বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) এর সাধারণ সম্পাদক বিভূতোষ রায়।

তিনি বলেন, দলিতদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা চরম দারিদ্র্য। তাছাড়া সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মেয়েদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ও পেশাগত লজ্জাও এজন্য দায়ী। এসব কারণে দলিত পিতা-মাতা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন আগ্রহ বোধ করেন না। তবে সময় পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি।

তিনি বলেন, দেশে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা কত- তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। এই পরিসংখ্যান না থাকাই তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে দলিতদের বিষয়ে পৃথক কোন তথ্যের উল্লেখ নেই।

সমাজসেবা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ৬৩ লাখ। সমাজসেবা অধিদফতরের বিভাজনভিত্তিক হিসেব অনুযায়ী, দেশে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ ও হরিজনদের সংখ্যা ১৫ লাখ। তবে যশোরে দলিত সম্প্রদায়ের ঠিক কত সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন তারও কোন সঠিক হিসেব নেই।
একদা ঈশ্বরপুত্র বলে অভিহিত এই হরিজনরা দিনাতিপাত করছে অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে। অথচ ওদের ঝাড়ুর ছোঁয়ায় পুরো নোংরা শহর চকচকে হয়ে ওঠে প্রতিদিন। তার পরও ওই দুখী মানুষগুলোর খোঁজ রাখে না কেউ। একদিন এমন দলিত শ্রেণির মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর।

স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী এবং সংবিধান রচনা কমিটিরও প্রধান ছিলেন তিনি। তার শিক্ষাজীবনে তিনি অসংখ্যবার জাত-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। তবু তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। হরিজনদের সন্তানদের সামনে তার আদর্শ এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সেই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে একদিন অনেক বড় হবে অর্জুন-করণ, অভিজিৎ, শিপন শুভরা। সে প্রত্যাশা হরিজনদের বাবা-মা আর শিক্ষকদের।

সংবাদটি শেয়ার করুন


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পূর্বানুমতি ব্যাতিত এই সাইটের কোন লেখা, ছবি বা ভিডিও ব্যাবহার করা নিষিদ্ধ।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com