মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক :
প্রতারণা বা অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরেই ছিল, তবে বিগত এক দশকে এ যেন এক সামাজিক ব্যাধিতেই রূপান্তরিত হয়েছে।
একযুগ আগেও প্রতারকরা সমাজে ঘৃণিত মানুষ হিসেবেই পরিচিত হতো। কিন্ত আজকাল গ্রহণযোগ্যতার মাত্রাটি যেন পালটে গিয়েছে। সেই সঙ্গে এর রূপটিও ভিন্নমাত্রায় বিকশিত হয়েছে। অর্থাভাব, বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা এমন নানা মাত্রার অসহিষ্ণুতায় এক সময় মানুষ জড়িয়ে যেত প্রতারণায়, এক্ষেত্রে অর্ধ শিক্ষিত, দরিদ্র বিপথগামী মানুষগুলো প্রতারণাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন মনে করত।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ এ ধরনের মানুষগুলোকে করুণার চোখে দেখতো। তবে কোন কালেই এরা সমাজপতি সেজে সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা যেমন করেনি ঠিক তেমনি প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে কারও নিয়ন্তা হওয়ারও চেষ্টা করেননি। কখনো এটি উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের পেশাও হয়ে উঠেনি।
তবে যখন থেকে শিক্ষিত, মেধাবী আর চৌকসরা প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়, অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায়, তখন থেকেই শুরু হয় প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণ। আর এমন দুষ্ট চক্রের সামাজিকীকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কথা, যারা প্রায় চার লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা; যার সরাসরি প্রভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় দেড় কোটি প্রান্তিক মানুষ। এ প্রতারণার অনুসন্ধানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীনকে প্রধান করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন; ২০১১ সালে রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে আরও একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। প্রশাসক নিয়োগ করে বারবার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আলোচিত হলেও আইনি মারপ্যাঁচ আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আজও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
এমএলএম কোম্পানি আইনের সুযোগ নিয়ে গঠিত ডেসটিনি, ২০০০-২০১২ সালে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় আমজনতার ৫০০০ কোটি টাকা, গ্লোবাল গেইন ইন্টারন্যাশনাল ১৩ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে আড়াইশ কোটি টাকা। ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণের বর্ধিত সংস্করণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ই-কমার্স। যার সুযোগ নিয়ে নোভেরা প্রোডাক্টস ৪০ হাজার ডিসট্রিবিউটর নেয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। ২০ হাজার লোককে চাকরি দেয়ার কথা বলে লাইফওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড হাতিয়ে নেয় ৭০ কোটি টাকা। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণার খবরে তো এখনো হাজার হাজার গ্রাহকের আহাজারিতে রাজপথ উত্তপ্ত। প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের এমন অবারিত সুযোগ পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে আছে বলে জানা নেই।
আজকাল ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ নিয়ে এটি যেন অনেক উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদেরও পেশা হয়ে উঠছে। বছরে কয়েক আগে আমার এমপি.কম নামে একটি ওয়েবসাইটের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবন্ধ হয়েছিল। ভেবেছিলাম এটি বোধ হয় সরকার নিয়ন্ত্রিত আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্য মহোদয়দের কোনো প্লাটফরম। যেখান থেকে এমপি সাহেবদের অ্যাম্বাসেডার নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল।
প্রতিদিনই নতুন নতুন সংসদ সদস্য আর তাদের অ্যাম্বেসেডার যোগদানের সংবাদ আমাকে বড় বেশি আগ্রহী করে তুলেছিল। উৎকণ্ঠা অবসানে আমার এমপি.কমের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মেধাবী তরুণ,লন্ডন প্রবাসী প্রকোশলী সুশান্ত দাশগুপ্ত নাকি(!) প্রচার করেন তিনি সরকারের অত্যন্ত উঁচু মহলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। সরকারের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে, সংসদ সদস্য মহোদয়দের সরাসরি জনগণের জবাবদিহিতার আওতায় এনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে উন্নয়নকে তরান্বিত করতে সেই নীতি-নির্ধারকের পরামর্শেই নাকি(?) আমার এমপি.কমের আত্মপ্রকাশ। তাই আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই বিগত কয়েক বছর যাবত অনেক আগ্রহ আর প্রত্যাশা নিয়ে আমার মতো অনেকেই অবলোকন করছিল আমার এমপি.কমের কার্যক্রম।
সম্প্রতি আমার এমপি.কমের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও সংসদীয় এলাকার ই-কমার্স কো-অর্ডিনেটরের সর্বমোট ৪৬৭৮৪টি পদে নিয়োগ দিচ্ছে আমার এমপি.কম ( amarmp.com)। যে দেশে লাখ লাখ বেকার তরুণ হন্যে হয়ে প্রতিদিন চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই দেশে একসঙ্গে অর্ধ লাখ বেকার চাকরি পাবে- এমন সংবাদে কার না ভালো লাগে বলুন! কিন্তু চারিদিকে প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণ যখন তুঙ্গে সেই সময়ে এ রকম বিশাল আকারের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আনন্দ আর শঙ্কা নিয়ে আমি যখন দোদুল্যমান- এমন সময়ে হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্র চাকরি দেয়ার নামে আমার এমপি.কমের প্রতারণার সংবাদ প্রকাশ করে।
যুবক, ডেসটিনি, গ্লোবাল গেইন, নভেরার মতো তদন্তে প্রমাণিত না হলেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার এমপির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি নানা কারণেই শঙ্কার জন্ম দেয়। ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত আমার এমপি.কম কখন, কীভাবে একটি ই-কমার্স বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো তার কোনো প্রমাণ প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে নেই। অর্ধ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির আছে বলেও কোনোভাবেই প্রতীয়মান হয় না। আমার হবিগঞ্জ নামে একটি অনলাইন ভিত্তিক সংবাদপত্র ব্যতীত আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার দৃশ্যমান প্রমাণ নেই।
কেউ হয়তো বলবেন, যাচাই-বাছাই না করে চাকরি প্রার্থীরা আবেদন করে কেন? যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন, এমপি, মন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন, ডিজিটাল বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টাকে তার ঘনিষ্ঠজন বলে প্রচার করেন, এমন মানুষকে আমার মতো খেটে খাওয়াদের বিশ্বাস না করে উপায় কী? আবার কেউ হয়তো বলবেন, প্রতারণা তো এখনো প্রমাণিত সত্য নয়। একমত হয়ে বলব- চূড়ান্ত প্রতারণা সংঘটিত হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্টদের সতর্কতা জরুরি নয় কী?
প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকার-ই দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সাংবিধানিকভাবেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর অর্থনৈতিক প্রতারণা যখন সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠে, তখন রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের কঠোরতা ছাড়া এর প্রতিকারও হয়ে উঠে অসম্ভব। শুধুমাত্র একটি দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নয়, জাতির পিতার যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ হাসিনার সরকারের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পরিমাণটাও বেশি। তাই ডিজিটালাইজেশনের সুযোগে ই-কমার্সের নামে প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ রোধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করে আইনের কঠোর অনুশাসন এখনই জরুরি হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply