মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৪০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি :
“আজকে আমার এই পৃথিবীর অনেক কিছু চেনা,
ব্লাক বোর্ডের ঐ কালো আকাশ, আমায় এনে দেনা।
এনে দেনা বয়স টাকে ৬ কিম্বা ৭,
হয়তো তবে ফিরে পেতাম স্যারের কোমল হাত।
সালাম জানাই সহস্রবার আমার তিনি গুরু।
তার কাছেই হয়েছিল শিক্ষা জীবন শুরু”।
প্রখ্যাত গায়ক জেমস্ এর বিখ্যাত এই গানটিই প্রকাশ করে শিক্ষকদের প্রতি জাতীর শ্রদ্ধা কত ঊর্ধ্বে। সমাজে যারা বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, জজ, ব্যারিস্টার, ব্যাংকার এমনকি রাষ্ট্র নায়ক পর্যন্ত সকলেই শিক্ষকের নামটি শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে নেন। এতে দ্বিমত থাকে না যে, একটি সুন্দর জাতী গঠনে শিক্ষকই সর্বউচ্চ গুরুত্ব বহন করেন। শিক্ষকতার পেশাটা একটি মহৎ ও অত্যান্ত সম্মানিত পেশা।
সরকার উপলোদ্ধি করলেন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশকে আরও উন্নত করার জন্য জাতীকে প্রথমে নিরক্ষরতার কালো থাবা থেকে মুক্ত করতে হবেই। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেন। সরকারের অন্যান্য সেক্টর গুলোতে যখন দূর্নিতির ঘনঘটা তখন সরকারের মহৎ উদ্যোগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ সঠিক ভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌছানোর জন্য আস্থা রাখলেন মহৎ ও সম্মানীত পেশা “শিক্ষক” নামক শিক্ষাগুরুদের প্রতি। সেই থেকেই সরকার নিশ্চিন্তে দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষকদের হাত দিয়েই সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে উপবৃত্তির অর্থ বন্টন করে আসছেন।
আমাদের সমাজে মহৎ পেশাকে কুলোশিত করার জন্য এক শ্রেনির মানুষও বিদ্যমান রয়েছে। ঠিক তেমনি মহৎ এই শিক্ষক পেশাটাকে কুলোশিত করার জন্য এবং সরকারের গতিশীল পদক্ষেপকে বাধা গ্রস্থ করার জন্য কিছু খারাব ও পরসম্পদলোভী শিক্ষক ও আছে এই সমাজে। এমনই এক শিক্ষকের খোঁজ মিলেছে সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার গড়ুইমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গড়–ইমহল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আক্তারুজ্জামান আক্তার এর বিরুদ্ধে উপবৃত্তির টাকা আত্মস্যাৎ এর আভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় এলাকাবাসীর মাধ্যমে জানা যায়, মোঃ মাহমুদ হোসাইন (৩য় শ্রেনি), মোঃ ইরাত (২য় শ্রেনী), মোঃ রাকিব (৫ম শ্রেনী) সহ প্রায় ১৫ জন ছাত্র-ছাত্রীগন দীর্ঘদিন যাবৎ উপবৃত্তির টাকা পান না।
বাকী সকল ছাত্র-ছাত্রীরা উপবৃত্তির টাকা পেলেও তারা টাকা পাইনি, না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান আক্তার “ দুই কোটার টাকা এক সাথে দেবেন বা কাগজ পত্রের সমস্যা আছে, পরে টাকা পাওয়া যাবে বা অন্য কোন নম্বরে টাকা চলে গেছে” এমন সাত পাঁচ বুঝিয়ে ফেরত পাঠাতেন অভিভাবকদের। দীর্ঘ দিন টাকা না পাওয়ায় মাহমুদ হাসানের পিতা মোঃ শাহিদুল ইসলাম পুনঃরায় প্রধান শিক্ষক আক্তার স্যারের নিকট বিষয়টি জানতে চাইলে টাকা ভুল নম্বরে চলে গেছে এমন বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নাছড় বান্দা শাহিদুল সেই ভুল ফোন নম্বরটি জানতে চাইলেন ? প্রধান শিক্ষক অনিচ্ছা সর্তেও শাহিদুলের জোরা জরিতে উক্ত নম্বরটি (০১৮১০…৫৮৭) দিতে বাধ্য হন। অভিভাবক শহিদুল বিভিন্ন কৌশলে উক্ত নম্বরের সাথে যোগাযোগ করে অবশেষে পরিচয় শানাক্ত করেন।
জানা যায় উক্ত নম্বরটি একই এলাকার ও একই স্কুলের ৫ম শ্রেনির ছাত্রী মোছাঃ ফাতিমা সুলতানার পিতা মোঃ আব্দুল জুব্বার গাজীর। জুব্বার গাজীর নিকট বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান “ তার কন্যা ফাতিমার উপবৃত্তির টাকার জন্য আক্তার স্যার জাহাঙ্গীরের (সাথী টেলিকম) দোকান থেকে একটি সিম ক্রয় করে নগদ একাউন্ট খুলতে বলেন। তিনি (০১৮১০…৫৮৭) সিমটি ক্রয় করে নগদ একাউন্ট খোলেন। পরে তার মোবাইলে তার কন্যার উপবৃত্তির প্রথম কোটা ৪৫০/- টাকা আসে। তিনি টাকা উত্তোলন করতে যেয়ে দেখতে পান তার মোবাইলে ৯০০/- টাকা আছে।
তিনি টাকা উত্তোলন করে বাড়িতে আসলে রাতে আক্তার স্যার তার বাড়িতে আসেন এবং তাকে বলেন “তোমার মোবাইলে ৪৫০/- টাকা বেশি এসেছে। ওটা তুমি রেখে দেবে এবং পরের ২য় ও ৩য় কোটার টাকা উত্তোলন করে আমাকে দেবে। সেই সাথে এই টাকার বিষয়ে কেউ ফোন করলে পরিচয় গোপন রাখবে। তা না হলে তোমার কন্যার উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে”। স্যারের নির্দেশে জুব্বার মোবাইলে তার পরিচয় গোপন করেছিলেন। পরে ২য় ও ৩য় কোটায় তার মোবাইলে টাকা আসে। আক্তার স্যার আবার তার বাড়িতে আসেন এবং এলাকার দোকান থেকে টাকা উত্তোলন না করে বাহিরের দোকান থেকে টাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেন। স্যারের আদেশ মত তিনি রতনপুর বাজার থেকে তার কন্যার উপবৃত্তির প্রাপ্য ২য় ও ৩য় কোটার ১৮০০/- টাকা উত্তোলন করেন। পরে রাতে আক্তার স্যার তার কাছে টাকা চাইলে তিনি ১৮০০/- টাকা উত্তোলন করেছেন জানান। স্যার বাকী ১৮০০/- টাকা উত্তোলনের জন্য জুব্বারের নিকট থেকে তার সিমসহ মোবাইল নিয়ে যান।
দীর্ঘ প্রায় এক মাস মোবাইল সিম ফেরত না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে আক্তার স্যার পরের কোটার টাকা উত্তোলন করার পর মোবাইল সিম ফেরত দেবেন বলে জানান। পরে জুব্বার বিষয়টি স্থানীয় মেম্বর ও স্কুলের সহ-সভাপতি মোঃ সাইফুলকে জানান। এরপর স্থানীয় শালিসে উপস্থিত সকলের সামনে জুব্বারের কাছে থাকা ৪৫০/- টাকা আক্তার স্যারকে ফেরত দেন এবং স্যারের ভাই আব্দুর রহিম জুব্বারের মোবাইল সিম ফেরত দেন”। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রের বড় ভাই মোঃ মাছুম সহ এলাকার অনেকেই জনান যে, “আক্তার স্যার অনেককেই প্রায়ই জানাতো তাদের টাকা ভুল নম্বরে চলে গেছে। পরে আমার ভায়ের টাকাটা ফেরত পাওয়ার জন্য সেই নম্বরে কথা বলি কিন্তু পরিচয় দিতে চাননি।
পরে কৌশলে পরিচয় জেনে জানতে পারি আক্তার স্যার কৌশলে অন্য ক্লাসের এক ছাত্রীর অভিভাবক মোঃ আব্দুর জুব্বারের নম্বরে টাকা ঢুকিয়ে সেই টাকা আতœস্যাৎ করেছেন। এর পর স্থানীয় মেম্বর ও স্কুলের সহ-সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম শালিস করেন। সেখানে আক্তার স্যার অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন এবং মেম্বরের মাধ্যমে আমার ভাইয়ের প্রাপ্য উপবৃত্তির ২২৫০/- টাকা পরিশোধ করেছেন”। এ সময় ভুক্তভোগী সহ এলাকার সকলের নিকট ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সকলে বলেন, আক্তার স্যার চাকুরী জীবনের শুরু থেকে একই স্কুলের কর্মরত থাকার সুবাদে এলাকার নিরিহ অভিভাবকদের ভুল বুঝিয়ে সরকারি উপবৃত্তির বহু টাকা আত্মস্যাৎ করে আসছেন।
একটা ছাত্রের উপবৃত্তির ২২৫০/- টাকা আত্মস্যাৎ এর ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু শালিসে আক্তার স্যার তার অপরাধ স্বীকার করার পরও তার কোন প্রকার জরিমানা হয় নাই বা অপরাধের সাজা হই নি। এতে সে তার অপরাধী কার্যক্রম অব্যহত রাখবেন বলে সকলের ধারনা। এছাড়া তিনি সরকারের মহৎ উদ্যোগটাকে বাঁধা গ্রস্থ করছেন। উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ায় গড়ুইমহল গ্রামের অনেক শিশুই স্কুল বিমুখ হয়ে পড়েছেন এবং অনেকেই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রাক্তান ছাত্র জানান আক্তার স্যার একজন অসৎ প্রকৃতির শিক্ষক। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবদের কাছে তাদের নামে মিথ্যা বিচার দেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করতেন।
এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তিনি ছাত্রদের কাছে মাছ ও সবজি আবদার করতেন। স্যারের আবদার পুরন করতে ছাত্ররা প্রায় স্যারকে মাছ ও সবজি উপহার দিতেন। যেটি প্রতিবেশিদের ঘের ও ক্ষেত থেকে চুরি করা। এতে করে অনেক ছাত্র রিতিমত শিশু চোরে পরিনত হয়ে যায়। আমি তখন স্যারের এমন কর্মকান্ডকে মজা ভাবতাম। কিন্তু এখন বুঝি স্যার একজন লোভী মানুষ যার ফলে স্যার কোমল মতি শিশুদের দিয়েও অপরাধ করাতে দ্বীধা করত না। এমন শিক্ষকের সঠিক বিচার হওয়া উচিত।
মাছুমা পারভীন নামের একজন প্রাক্তান ছাত্রী বলেন, “শিক্ষক মানুষ এমন জঘন্য হতে পারে আক্তার স্যারকে না দেখলে বুঝতাম না। আক্তার স্যার রতনপুর বাজারের হাজী বস্ত্রলয় থেকে একবার শাড়ী ও পাঞ্জাবী চুরি করে ধরা পড়েছিলেন। তাছাড়া তিনি নাজিমগঞ্জ এক জুতার দোকান থেকে অন্যের নাম ঠিকানা দিয়ে জুতা বাকী নিয়ে এসে পরে ধরা পড়েছিলেন। এখন কোমলমতি শিশুদের টাকা অত্মস্যাৎ করছে। এমন পরসম্পদলোভী চোর কিভাবে শিক্ষক হিসাবে থাকতে পারে? এদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
এবিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক আক্তার স্যার বলেন “ এটা একটি অনাকাংখিত ভুল, এধরনের ভুল আর করব না। স্থানীয় শালিসে বিষয়টি মিমাংষা হয়ে গেছে। উক্ত বিষয়টি নিয়ে কোন প্রতিবেদন করো না, তোমাকে আমি খুশি করব”।
বিষয়টি নিয়ে স্কুলের সহ-সভাপতি ও স্থানীয় মেম্বর মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন “বিষয়টি নিয়ে আক্তার স্যার, অভিভাবকগন ও এলাকাবাসী সহ সকলে বসে স্থানীয় ভাবে মিমাংসা করেছি। তিনি একজন শিক্ষক মানুষ, একটা অপরাধ করে ফেলেছেন। একবারের মত তাকে সুযোগ দেওয়া হইল। পরের বার এমন করলে আর ছাড় দেব না।
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ছামছুন নাহার বলেন,এব্যাপারে কোন অভিযোগ পাইনি । তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার রুহুল আমিন বলেন,বিষয়টি আমি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। আমি এখনি খোঁজ নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন,যদি বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
Leave a Reply